কোনো ব্যক্তির কাছে বা দপ্তরে গেলে কেউ যখন কিছু কাগজ ধরিয়ে দেয় অথবা আপনা আপনি গড় গড় করে তথ্য উপাত্ত দেয় এবং এগুলো নিয়ে আমরা যখন সংবাদপত্রে কিছু লিখি এবং ছাপি এগুলো নিশ্চয়ই সংবাদপত্রের অংশ, সংবাদপত্রের কনটেন্ট, সংবাদপত্রের আধেয়, কিন্তু আর যাই বলা হোক প্রক্রিয়াটিকে সাংবাদিকতা বলা যাবে না।
এটা হচ্ছে ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের PR, পাবলিক রিলেশন্স। একটি সংবাদপত্রে অনেক কিছুই ছাপা হয় তাই বলে সেগুলো প্রকৃত সংবাদ নয়, সাংবাদিকতা তো একেবারেই না। যেমন সংবাদপত্রে আজকাল ছাত্রদের শিক্ষাদান করা হয়, সেখানে সাহিত্য ছাপা হয়, গল্প, কবিতা, উপন্যাস। সংবাদপত্রে খাবারের রেসিপি ছাপা হয় এমন আরো কতো কিছুই আছে যা আজকাল সংবাদপত্রের অংশ বটে কিন্তু সাংবাদিকতার অংশ নয়।
সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা সংখ্যা যতো বেড়েছে একই হারে সাংবাদিকতার চর্চা বাড়েনি বরং সাংবাদিকতা কম হচ্ছে বলে তার শূন্যস্থান পূরণ করতে দিনের পর দিন এসেছে, একের পর এক নিত্য নতুন কনটেন্ট বা আধেয়, পড়ার বিষয়, রিডিং মেটারিয়াল। সংবাদপত্রের এই বিচিত্র কনটেন্ট মানুষের জীবনে গুরুত্ব নেই বা ওই কনটেন্ট এর ব্যাপারে পাঠকের আগ্রহ নেই আমি সে কথা বলছিনা, কিন্তু পাঠকের তুমুল আগ্রহ থাকলেই সব সময় সংবাদপত্রের যেকোনো কনটেন্টকে সাংবাদিকতা হিসেবে আখ্যা দেয়া বা ব্যাখ্যা দেয়া সঠিক নয়।
সাংবাদিকতায় একটি সংবাদ রচনার জন্য নিউজ গেদারিং এর একটি প্রক্রিয়া থাকতে হবে। সেই প্রক্রিয়া সাধারণত শ্রম সাপেক্ষ। যথেষ্ট লেগ ওয়ার্ক থাকবে। অনেকের টেবিলে ঘুরতে হবে, অনেক মানুষের সাথে কথা বলতে হবে। তথ্য উপাত্তের সঠিকতা যাচাই বাছাই করে নিশ্চিত হতে হবে, এই বিষয়ে কোনো ভিন্ন পক্ষ থাকলে তাকেও যথাযথ সুযোগ দিতে হবে। তার পক্ষের তথ্য, বিশ্লেষণ যোগান দিতে হবে। এভাবে সাংবাদিকতা নূন্যতম পক্ষে একটি কষ্টকর কাজ। কষ্টসাধ্য কাজ।
সাংবাদিকতা কেবল কষ্টকর তা নয়, পরিশ্রম আর কষ্টের সঙ্গে সাংবাদিকতা অনেক বাধারও মুখোমুখি করে।
পরিশ্রম আর কষ্ট সাংবাদিকতায় যখন বাধা আসে তখন বুঝতে হবে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর নিয়ে কাজে ঢুকেছি। বাধা যতো শক্তিশালী হবে সংবাদের তাৎপর্য ততোই বাড়বে। The significance of the reporting project is directly proportionate to the obstacles the reporter may have to face while news gathering.
অনেক সময় বাধা প্রলোভনের রুপেও আসতে পারে। একটি রিপোর্টিং না করার জন্য কেউ টাকা সাধবে বা অন্য কোনো সুবিধা দিতে চাইবে। এইগুলোও একধরনের বাধা যা সাংবাদিককে নির্লোভ হয়ে কায়দা করে এড়িয়ে যেতে হয়।
সাংবাদিকতায় কেবল বাধা নয় প্রকৃত জনস্বার্থ বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাংবাদিকতা করতে গেলে অনেক সময় হুমকি ধামকি এমনকি মামলা, হামলা ও প্রাণনাশ প্রচেষ্টা চলে আসতে পারে। তখন সাংবাদিককে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য যথাযথ কৌশল এবং সিনিয়রদের সাথে পরামর্শ করে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। নির্বিকারভাবে আত্মহননের পথ সাংবাদিকতা নয়। নিরাপত্তার সর্বোচ্চ নিশ্চয়তার পাশাপাশি সাহস ও কৌশলের সাথে নিউজ গেদারিং বা সংবাদ সংগ্রহের সকল প্রক্রিয়া ও ধাপ যথাযথ সম্পাদন করতে হবে। যত বড় হুমকি ততোই গুরুত্বপূর্ণ সেই খবর। এমন প্রতিবেদন করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকতা তথা বিশ্বমানের সাংবাদিকতায় অংশ হওয়ার সুযোগ।
এই যে, জীবনাশঙ্কা, হুমকি, বড় বড় বাধা বিঘ্ন, এগুলো পেরিয়ে যে, সাংবাদিকতা, এগুলো উচ্চতর মর্যাদার সাংবাদিকতা। গৌরবের সাংবাদিকতা। প্রকৃত সাংবাদিকতা।
সাংবাদিকতা আরাম আয়েশে করার পেশা নয়। হুমকি ধামকি প্রাণনাশের প্রচেষ্টা মোকাবেলায় রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। সেইটা নাগরিক সমাজের সাথে আমরা উচ্চ কণ্ঠে দাবি করতে থাকবো কিন্তু সাংবাদিকতা যতোদিন থাকবে এর সাথে কষ্ট পরিশ্রম বাধা হুমকি ইত্যাদি থাকবে। এটা সাংবাদিকতা পেশার অপরিবর্তনীয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তবে এই শ্রম কষ্ট হুমকি ইত্যাদি যুগে যুগে তার রুপ বদলাবে।
যদি এমন দিন আসে যেকোনো মানুষ চাহিবামাত্র প্রয়োজনীয় তথ্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে যায় তখন একই হারে সাংবাদিকতার প্রয়োজনও ধাপে ধাপে ক্রমহ্রাসমান হবে। মানুষের জানার ক্ষেত্রে যদি পরিশ্রমের বা দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন না পরে, কোথাও তথ্য প্রাপ্তিতে কোনো বাধা না থাকে অথবা কারো রক্তচক্ষু বা হুমকিও না থাকে তখন সাংবাদিকতার আদি ও অকৃত্রিম ধারণায় আর প্রয়োজনও থাকবে না। সাংবাদিকতায় করণীয় এবং সাংবাদিকতার ধারণা এভাবে ধাপে ধাপে বদলে যাবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, নাঈমুল ইসলাম খান